স্মৃতি চারণা: Memories: Preacher একজন সাধারণ বাস কন্ডাক্টর থেকে দ্বীনের দ্বায়ী হয়ে ওঠা মানুষটির কথা শেখ সিরাজুদ্দীন আহমেদ, সাদা পাকা চুল...
স্মৃতি চারণা:
Memories: Preacher
একজন সাধারণ বাস কন্ডাক্টর থেকে দ্বীনের দ্বায়ী হয়ে ওঠা মানুষটির কথা
শেখ সিরাজুদ্দীন আহমেদ, সাদা পাকা চুল আর দাড়ির সঙ্গে সাদা পাঞ্জাবির দারুণ মেলবন্ধন। নিরহংকার, মিষ্টভাষী, অথিতি পরায়ণ, অনাড়ম্বর জীবনের অভ্যস্ত। তিনি পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। তিনি তার চলার পথে রেখে গেছেন দ্বীনের আদর্শের কিছু মানুষ। তাঁর বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন রাকিবুল ইসলাম।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার লাউহাটির শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে খুব বেশি মেশার সুযোগ হয়নি। তবে যে স্বল্প সময়ে যতটা কাছাকাছি আসা গেছে তাতে ওনাকে নিজের অনেক কাছের একজন মনে হয়েছে। সবচেয়ে মাজার বিষয় হল এই ধরনের মানুষগুলো সকলের আপনজন হন। সবাই তাকে কাছের মানুষ ভাবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেক বার দেখা হয়েছে। তবে যখন উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জামাআতে ইসলামী হিন্দের মিডিয়া ইনচার্জের দায়িত্ব পাই, তখন তিনি জেলার পাব্লিক রিলেশন ইনচার্জ। তখন থেকে ঘনিষ্ঠতা অনেকটা বাড়ে। তখন থেকে কমবেশী জানার সুযোগ হয়। পরবর্তীতে জেলা জামাআতে ইসলামী হিন্দের দাওয়াত বিভাগে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে জামাআতের বিভিন্ন ধর্মমতের ঐক্য সংহতি বিষয়ে সকল ধর্মের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হওয়া সদ্ভাবনা মঞ্চের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ইনচার্জ নিযুক্ত হন।
বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার জেলা সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম, জেলার সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল আজীজ মোল্যা এবং রাইগাছি মোকামের প্রবীন রুকন কাশেম আলি হাজরা সাহেবের স্মৃতিচারণায় অনেক অজানা কথা উঠে আসে। সময়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিয়মানুবর্তী। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। যদিও তাঁর স্কুলের শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। তিনি খুব তাড়াতাড়ি বিভিন্ন বিষয় আয়ত্ত করতে পারতেন। পবিত্র গীতার অনেক শ্লোক আন্তঃধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠানে গড়গড় করে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন মনে হতো কোন পুরোহিত শ্লোক বলেছেন। তিনি নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলেন। মহান প্রভুর কাছে উচু নিচু বলে যে কিছু হয় না এ কথা নিম্নবর্ণের মানুষদের সম্পর্ক স্থাপনের সময় তুলে ধরেন। একবার এক নিম্নবর্ণের হিন্দু পরিবার তাকে কিছু খাবার পরিবেশন করলে তিনি সেটা খাওয়ায় তারা অত্যন্ত খুশি হন। এভাবে তিনি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন।
লাউহাটি বাজারের উপর মসজিদের কাছে শেখ নিজামুদ্দিন সাহেবের ওষুধের দোকান ছিল। সেখানে জড়ো হতেন আফতাব উদ্দিন সাহেব, গুচুরিয়ার সিরাজ সাহেব। সেখানে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা হতো। মাঝে মাঝে শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেব সেখানে বসতেন। লাউহাটি বাসস্ট্যান্ডে শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেবের বাবার চায়ের দোকান ছিল। কখনও আলোচনা চায়ের দোকানেও হত। শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেব লাউহাটি ধর্মতলা রুটের বাসের কন্ডাক্টর ছিলেন। ধর্মতলা যাওয়ার সূত্র ধরে জামাআতে ইসলামী হিন্দের অফিসে তিনি যাতায়াত করতেন। সেখানেও বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়। প্রথম দিকে তিনি কমিউনিস্ট ভাবধারার লোক ছিলেন। একদিনের একটা ঘটনা, তখন ধর্মতলার অফিসে ছিলেন নজির আহমদ সাহেব। তিনি তার কাছ থেকে সংগঠনের গঠনতন্ত্র নেন। সমান্য কয়েক পয়সা তার দাম, সেই দাম মিটিয়ে দিয়ে তিনি অফস থেকে বেরিয়ে এসেছেন। দেখেন তার পিছনে ছুটে এসেছেন নজির আহমেদ সাহেব। তাঁর হাতে বইয়ের বিলটা ধরিয়ে দিয়ে চলে যান। এই ঘটনা তাকে অবাক করে। সামান্য কয়েক পয়সা একটা বইয়ের দাম তারও বিল দেয়! এভাবে ধীরে ধীরে তিনি জামাআতে ইসলামী হিন্দের সংস্পর্শে আসতে থাকেন।
শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেব শুরু করলেন পড়াশুনা। সংগঠনের বিভিন্ন বই পড়তে লাগলেন। যতই পড়তে থাকেন ততই যেন পড়ার খিদে বেড়ে যেতে থাকে। তিনি কন্ডাক্টরী ছেড়ে দিলেন।লাউহাটি তিনমাথার মোড়ে বাবার বড় চায়ের দোকান ছিল। সেখানে বাবার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। এরপর বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডা. জেড খানের চেম্বারে থাকতেন। তখন লাউহাটিতে ডাক্তারবাবুর চেম্বার ছিল। ওনার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ডা. খান হাড়োয়ার চেম্বারে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে আসতে বলতেন। এই সময়ে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। ডাক্তারের চেম্বার থেকে যা পেতেন মোটামুটি ভাবে দিন চলে যেত। সংগঠনে ভালোরকম সময় দিতে হত, ফলে নিজের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরানোর সুযোগ কম ছিল। তবে অন্যের জন্য বিভিন্ন সময়ে ডা. জেড খানের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেও নিজের দারিদ্রতার কথা কাওকে বলেননি।
বিভিন্ন সময় পথসভায় যখন বক্তব্য রাখতেন। তিনি স্বল্প সময়ে বিষয় সম্পর্কে খুব সুন্দর ভাবে আলোচনা রাখতে পারতেন। তবে তাঁর কথা দ্রুততার জন্য একটু অমনোযোগী হলে বুঝতে কঠিন হত।
২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের সময় প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলো। বিশেষত দুই চব্বিশ পরগনায় প্রচুর ক্ষতি হয়। জামাআতে ইসলামী হিন্দের কর্মীরা ত্রাণ কার্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাসনাবাদ-সন্দেশখালি ব্লকে ত্রান শিবির খোলে। ফ্রী চিকিৎসা পরিসেবারও ব্যবস্থা করে জামায়াত। দীর্ঘ তিন-চার বছর শেখ সিরাজুদ্দীন সাহেব সন্দেশখালি ব্লকের সরবেড়িয়ায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। প্রচুর রোগী তার চিকিৎসায় উপকৃত হয়।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার স্বপ্ন ছিল দাওয়াতে দ্বীনের ময়দানে নিজেকে উজার করে দেওয়া। যখন তিনি অসুস্থ তখনও বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যখন অতিরিক্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন জেলা সভাপতি মাওলানা রফিকুল ইসলাম, সহসভাপতি মাওলানা আজিজ সাহেব তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বারবার দোআ চাইতেন আর বলতেন আমি আবারও দাওয়াতের ময়দানে ফিরতে চাই। তিনি তখনও গুরুতর অসুস্থ হননি। নিজের মসজিদে জুম্মার দিন সকলের কাছে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন। হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মহান রবের কাছে ফেরার সময় হয়ে গেছে। গত ১৪ই মে, ২০২৪ আসরের নামাজের সময় আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেয় এই মানুষটি। মহান প্রভু আল্লাহ এই মানুষটির ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
COMMENTS