উপসম্পাদকীয়: সন্ত্রাসীদের কুকর্মের হিসাব কী চোকাতে হবে ভারতের সাধারণ মুসলিম জনগণের? সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা দেশের বিভিন্...
উপসম্পাদকীয়:
সন্ত্রাসীদের কুকর্মের হিসাব কী চোকাতে হবে ভারতের সাধারণ মুসলিম জনগণের?
সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু মুসলিম নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও গোটা হিন্দু সম্প্রদায় বা হিন্দু ধর্মকে দোষারোপ করা হয় না। কিন্তু নিকৃষ্ট খুনিদের দ্বারা কাশ্মীরে যে ঘটনা ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধীদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায় এবং ইসলামকে আঘাত করে বিভিন্ন লেখালিখি হচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তা বেষ্টনীতে মোড়া কাশ্মীরে এ ঘটনা কিভাবে ঘটল তার নিয়ে কোন প্রশ্ন করতে দেখা যাচ্ছে না।
রাকিবুল ইসলাম
পাহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসীদের নিশানায় এবার কাশ্মীরের রুটি রুজির একমাত্র উপায় দেশ-বিদেশের টুরিস্টরা। যে টুরিস্টরা কাশ্মীরের না গেলে তাদের জীবন জীবিকা অচল হয়ে পড়ে। কয়েকদিন ধরে মিডিয়া একটানা প্রচার করে চলেছে সন্ত্রাসবাদীরা ধর্মপরিচয় দেখে নৃশংসভাবে হিন্দুদের হত্যা করেছে। সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত হওয়া অনেকের মুখেও ঠিক এমন কথাই শোনা যাচ্ছে। তবে বিশেষ এক রাজনৈতিক দল এই গোটা ঘটনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চূড়ান্ত তাস খেলতে শুরু করে দিয়েছে। একদল তথাকথিত শিক্ষিত তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিদ্বেষ মূলক লেখনীর সাহায্যে তুলে ধরেছে ইসলাম এবং ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে। যদিও এই ঘটনায় গোটা ভারতবর্ষের সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষ প্রত্যেকেই শোকাহত এবং মর্মাহত। তারপরও দেখা যাচ্ছে ইসলাম এবং মুসলিমদের টার্গেট করে একটা ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দেশেও হিন্দুরা নিরাপদ নয়। আর এই নারীটিভকে প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯২৫ সাল থেকে রাত দিন এক করে কাজ করে চলেছে সেই আরএসএস। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পর তারা এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করতে অনেকটাই তারা সফল হয়েছে।
আপনাদের নিশ্চয়ই পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী কান্ডের কথা (২০১৯) মনে আছে। চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ানের পরিবার আজও কিন্তু সুবিচার পায়নি। এখনও স্পষ্ট কোন তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
আরও একটা ঘটনার কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিই আরপিএফ জওয়ান চেতন সিং (৩৩) মোদী এবং যোগীকে ভোট দেওয়ার কথা বলে একজন সহকর্মী ও তিনজন রেলের মুসলি
ম যাত্রীকে জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে হত্যা করে (আগষ্ট, ২০২৪)। এই ঘটনায় কিন্তু হিন্দু এবং হিন্দু ধর্ম নিয়ে মিডিয়ার প্রশ্ন তুলতে দেখা যায়নি। সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষকে ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বা কাওকে কখনও বলতে শুনিনি হিন্দু সহিংসতা শিক্ষা দেয়।
ওড়িশায় গ্রাহম স্টেনের দুই শিশু পুত্রসহ তিনজনকে নৃশংস ভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয় (জানুয়ারী, ১৯৯৯)। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী বজরং দলের সদস্য দারা সিং কে সাম্প্রতিক কালে মুক্তি দিয়েছে ওড়িশার বিজেপি সরকার। না এই হত্যার পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু দ্বারা হয়নি এটা আমরা বিশ্বাস করি। এখানে ধর্মকে আমরা কেউ কাঠগড়ায় তুলিনি।
তবে সভ্যতার এটা একটা ভয়ঙ্কর লজ্জা মেইনস্ট্রিম সংবাদ মাধ্যম থেকে শুরু করে আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র একটা ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুসারীদের টার্গেট করে লেখালিখি করা হচ্ছে। গুটি কতক হিংস্র নরপশুদের হিংস্রতার খেসারত কেন এদেশের সাধারণ মুসলিমদের চোকাতে হবে এ প্রশ্ন উঠেছে না! কাশ্মীরে যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের মোটিভ কী আজও স্পষ্ট নয়। তবুও হিন্দু নিধনের ধুয়ো তুলে হাওয়া গরম করছে একদল মানুষ।
এই প্রথম সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে কাশ্মীরে তেমনটা নয়। একজন ডাক্তার ও তিনজন পরিযায়ী শ্রমিককে হত্যা করা হয় (অক্টোবর, ২০২৪)। শ্রমিকদের সকলে মুসলিম ছিল। মিডিয়া বা তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি এখানে কোন হিন্দু বা মুসলিম নিধনে দেখতে পায়নি।
ভূস্বর্গের এবারের ঘটনা ভিন্নতর ছিল। এবার নাকি জঙ্গিরা পরিচয় শুনে হত্যা করছিল। সত্যিই কতটা ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত ভাবে কাশ্মীরের কোটি কোটি অর্থ ব্যয় করে রেখে দেওয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার চোখে ধুলো দিয়ে এতগুলো মানুষকে হত্যা করে পালিয়ে গেল! এটা কিভাবে সম্ভব হল এ প্রশ্ন কিন্তু বিজেপির সরকারের মদদপুষ্ট গণমাধ্যম করেনি। যে রাজ্যে একটা খেলনা বন্দুক নিয়ে একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যায় না সেখানে এটা কিভাবে ঘটতে পারে তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন মানুষকে অবশ্যই ভাবাচ্ছে। সামরিক পোশাক, অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ধর্ম পরিচয় শুনে খুন বারবার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ৩৭০ তুলে নেওয়া কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সামনে এ প্রশ্ন করার মতো মিডিয়া নেই! সেনাবাহিনীর বুটের আওয়াজে যাদের দিনের শুরু হয় এবং সেনাবাহিনীর বুটের আওয়াজে দিন শেষ হয় শুধুমাত্র টুরিস্টদের আসা যাওয়ার মাধ্যমে যাদের জীবন-জীবিকা এই ঘটনায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সেই দরিদ্র মানুষের অবস্থা আরও করুণ হবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সন্ত্রাসীদের জন্য গোটা কাশ্মীর শুধু নয় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী এবং গুজরাট থেকে হিমাচল প্রদেশের এই ভূখণ্ডের সকল মুসলিমদেরকে সফট টার্গেট করা হচ্ছে।
বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার স্যোশাল মিডিয়া কর্মী তালিব হুসেন শাহ ধরা পড়ে (জুলাই, ২০২২) সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগে। এক্ষেত্রে ভূস্বর্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা নিয়ে মিডিয়া বিজেপির বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ তোলেনি।
গোটা দেশের গদি মিডিয়া যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারতে তা তারা পুরোপুরি উল্টো আচরণ করে দেশের মানুষের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ বপন করছে। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কোন অপরাধ করে তবে তার দায় গোটা সম্প্রদায়ের উপর চাপানোর প্রবণতা উদ্যশ্য প্রণোদিতভাবে শুধুমাত্র মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর জন্মলগ্ন থেকেই আরএসএস এই ফর্মূলার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে পরিবেশ অশান্ত রাখতে চাইছে। তাদের দেখানো পথে চলছে অনেক মিডিয়া হাউজ।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরে গতি মিডিয়া আরএসএস দেখানো পথে যেমন হেঁটে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছিল একদল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সত্য তুলে ধরার কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধী সে যে ধর্মেরই হোন না কেন সে অপরাধী। পাকিস্তানের মুসলিম অপরাধ করলে তার দায় চোকাতে হবে ভারতের মুসলিমদের, আবার ভারতের হিন্দু অপরাধ করলে তার দায় চোকবে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের হিন্দু, এটা কখনোই কাম্য নয়। এই ধরনের প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে অবশ্যই তারা কোনভাবেই মানুষ হতে পারে না, তারা নরখাদক। আমরা বিশ্বাস করি যখন কোন দেশ সংকটের মধ্যে পড়ে তখন জেগে ওঠা প্রয়োজন সমাজের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষগুলো। এটা যদি সম্ভব হয় তবে অবশ্যই একটা উন্নত জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট হবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ভারতবর্ষ।
COMMENTS