বিশেষ প্রতিবেদন: এইদেশ মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে ৯৪৭টি বিদ্বেষজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে NDA সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে...
বিশেষ প্রতিবেদন: এইদেশ
মোদি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে ৯৪৭টি বিদ্বেষজনিত অপরাধের ঘটনা ঘটেছে
NDA সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে বিজেপির ঘৃণার রাজনীতির পরিসংখ্যান তুলে ধরল APCR-এর প্রতিবেদনে। ধীরে ধীরে হিন্দু মৌলবাদ বৃদ্ধি এবং হিংসাত্মক ঘটনা বৃদ্ধির জন্য একটা অনলাইন প্রোগ্রামে বিভিন্ন সমাজকর্মী বুদ্ধিজীবী আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।
বিশেষ প্রতিবেদন:
ভারতের কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছর পূর্তিতে একটি ভয়ঙ্কর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অব সিভিল রাইটস’ (APCR) ও ‘কুইল ফাউন্ডেশন’ (Quill Foundation)। এই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৯৪৭টি ঘৃণা ও বিদ্বেষজনিত ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে রয়েছে ৬০২টি ঘৃণাজনিত অপরাধ এবং ৩৪৫টি ঘৃণামূলক ভাষণ। এসব ঘটনার অধিকাংশই মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ঘটেছে।
এই উদ্বেগজনক তথ্য শুক্রবার সন্ধ্যায় একটি অনলাইন সভায় প্রকাশিত হয়, যেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। “Hate Crime Report: Mapping First Year of Modi’s Third Govt” শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। এটি একটি অশনি সংকেত বহন করে—বিশেষত নির্বাচনী প্রচার ও জাতীয় সংকটকালে ঘৃণার প্রতিষ্ঠানিকীকরণ এবং ব্যবহার বেড়ে গেছে, যেমন ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পরে দেখা গিয়েছে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা হিন্দু জনসংখ্যার একটি অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মৌলবাদ এবং ঘৃণাভাষণকে রাজনীতির স্বাভাবিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়ার নিরবতা:
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী অপূর্বানন্দ অনুষ্ঠানে বলেন, "যখন আদালত ও গণমাধ্যম ঘৃণাভাষণ উপেক্ষা করে, তখন সাধারণ মানুষ এর গুরুত্ব অনুভব করে না।" তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, "এটি ধীরে ধীরে এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যায়, যেখানে সাধারণ মানুষ এই ভাষা ব্যবহারকে স্বাভাবিক মনে করতে শুরু করে। কিন্তু যখন নির্বাচিত নেতারাই প্রতিদিন এই ভাষা ব্যবহার করেন, তখন বিপদের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।"
তিনি সরাসরি অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা-কে আক্রমণ করে বলেন, “তিনি প্রকাশ্যে বলেন মুসলমানদের সবজি বিক্রি করতে না দেওয়া উচিত, কারণ এতে দাম বেড়ে যায়। তিনি প্রতিদিন ‘লুঙ্গি পরা’ মুসলমানদের উপহাস করেন, বিশেষভাবে ‘মিয়া মুসলমানদের’ লক্ষ্য করে বক্তব্য দেন। এটা শুধু নির্বাচনের সময় নয়, এখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে।"
অপুর্বানন্দ আরও বলেন, "এই ধরনের ভাষা এখন ‘হিন্দু মনোভাবের’ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে—এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।" তিনি যোগ করেন, “এই বেড়ে চলা মৌলবাদ কেবল সংখ্যালঘুদের জন্য নয়, বরং হিন্দু সমাজের বিবেক ও মূল্যবোধের জন্যও হুমকি। এটি শুধুমাত্র আইন বা রাজনীতির বিষয় নয়—এটি হিন্দু সমাজের নৈতিক আত্মজিজ্ঞাসার বিষয়।"
তিনি বলেন, "এই প্রতিবেদনটি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে, কীভাবে ঘৃণাভাষণ এখন একটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক কৌশল হয়ে উঠেছে। যতক্ষণ না বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায়, এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে না। যতক্ষণ ঘৃণাভাষণ সরকার পরিচালনার বৈধ হাতিয়ার হিসেবে থেকে যায়, ততদিন এই ঘটনাগুলি চলতেই থাকবে।"
অন্যান্য বক্তার মতামত:
অন্যান্য বক্তার মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ড. জন দয়াল, আইনজীবী লারা জেসানি, মানবাধিকারকর্মী মানবী আত্রি, বিনয় শ্রীনিবাস, ফাওয়াদ শাহীন এবং তাজিন জুনায়েদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রিকৃতি, এবং প্রতিবেদনের বিস্তারিত উপস্থাপন করেন ফাওয়াদ শাহীন।
প্রতিবেদনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে এবং তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ও সামাজিক জবাবদিহিতা দাবি করে।
ঘৃণাজনিত অপরাধের ধরন ও সময়কাল:
মোট ৬০২টি অপরাধের মধ্যে:
১৭৩টি শারীরিক হামলা
২৫টি মৃত্যুর ঘটনা, সকলেই মুসলিম
সর্বোচ্চ আক্রান্ত রাজ্য:
উত্তরপ্রদেশ (২১৭টি ঘটনা)
মধ্যপ্রদেশ (৮৪টি)
মহারাষ্ট্র (৬৮টি)
ঝাড়খণ্ড (৫২টি)
উত্তরাখণ্ড (৩৬টি) উল্লেখযোগ্য যে, এই ২৫টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিই বিজেপি-শাসিত ছিল পুরো বছরজুড়ে।
সেপ্টেম্বর ২০২৪:
১৭ সেপ্টেম্বর, মহারাষ্ট্রের থানে-তে মোহাম্মদ ইরফান নামের একজন মুসলিমকে 'লাভ (Love) জিহাদ' ও 'Urine Jihad' -এর ভুয়া অভিযোগে এক হিন্দু গোষ্ঠীর সদস্যরা মারধর করে।
২০ সেপ্টেম্বর, উত্তরপ্রদেশের মুজাফফরনগরে মুসলিম পরিবার হিন্দু-প্রধান এলাকায় জমি কেনায় স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে আক্রান্ত হয়।
পন্না, মধ্যপ্রদেশে, গণেশ চতুর্থীর সময় হিন্দু মিছিল চলাকালে মুসলিমদের ঘরবাড়িতে হামলা হয়।
অক্টোবর ২০২৪ (৮০টি অপরাধ):
কানপুরে, ১৯ বছর বয়সী ফাইজান খানকে নবরাত্রির অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায় আক্রমণ করা হয়।
উজ্জয়িনে, গরবা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ায় শাহিদ আলীকে বজরং দলের কর্মীরা মারধর করে।
রামকান্দা, ঝাড়খণ্ডে, খ্রিস্টান প্রার্থনাসভা ভেঙে দেওয়া হয়, পাদরিদের ধর্মান্তরিত করার মিথ্যা অভিযোগে আটক করা হয়।
মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের একাধিক শহরে মুসলিম দোকান বয়কটের আহ্বান দেওয়া হয়।
ঘৃণামূলক ভাষণ: রাজনীতির অস্ত্র
প্রতিবেদনটি জানায়, ৩৪৫টি ঘৃণাভাষণের মধ্যে ১৭৮টি এসেছে বিজেপি নেতা বা তাদের সহযোগীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে বক্তব্য দিয়েছেন ৫ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও উত্তরপ্রদেশ, অসম, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা।
নভেম্বর ২০২৪, যখন ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন চলছিল, তখন রেকর্ডকৃত ৬২টি ঘৃণাভাষণের মধ্যে ৩৪টি ঘটেছে ঝাড়খণ্ডে এবং ১৫টি মহারাষ্ট্রে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাজনাথ সিং, ও শিবরাজ সিং চৌহান-এর বক্তব্যে “রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ” ও “মুসলিম তোষণ”কে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে।
পহেলগাম হামলার প্রতিক্রিয়া (এপ্রিল ২০২৫):
২৩ এপ্রিল ২০২৫, জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। পরবর্তী দুই সপ্তাহে ৮৭টি ঘৃণাজনিত অপরাধ ঘটেছে এবং ১৩৬ জন মুসলিম এই হামলার শিকার হন।
নৈনিতাল: মুসলিম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা
অম্বালা, হরিয়ানা: মোহাম্মদ শাদাবের দোকান ভাঙচুর
পশ্চিমবঙ্গে: বিভিন্ন কলেজ ও ক্যাম্পাসে মুসলিমদের নিষিদ্ধ করার পোস্টার
মুসৌরি: কাশ্মীরি শাল বিক্রেতাদের মারধর ও শহর ছাড়ার হুমকি
একটি গোরু রক্ষা গোষ্ঠী প্রকাশ্যে দাবি করে: তারা একজন মুসলিমকে হত্যা করেছে এবং 'পহেলগামের প্রতিশোধ নিতে আরও ২৬০০ জনকে হত্যা করবে।'
ভুক্তভোগীদের প্রোফাইল: শিশুরাও বাদ যায়নি
২৯৬৪ জন আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৬২ জন শিশু ও ১০ জন প্রবীণ নাগরিক।
আমরোহা, উত্তরপ্রদেশ: এক মুসলিম শিশু স্কুল ফাংশনে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাক পরায় বরখাস্ত হয়
অক্টোবর: রতলামে ৩ মুসলিম নাবালককে স্কুলে হামলার শিকার হতে হয়
জবলপুর: ৬৮ বছর বয়সী খ্রিস্টান যাজক থানার মধ্যেই মার খেয়েছেন, তিনি সহপাদরিদের সুরক্ষার আবেদন করতে এসেছিলেন
নির্বাচনের সাথে সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠানিক সহায়তা:
প্রতিবেদনে দেখা যায়, নির্বাচনী রাজ্যগুলোতে ঘৃণাভিত্তিক অপরাধ ও বক্তব্যের সংখ্যা বেড়ে যায়। দিল্লি, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, ও উত্তরাখণ্ডে নির্বাচনের সময় ঘৃণার গতি বৃদ্ধি পায়।
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী জানুয়ারিতে একমাসেই ১৪টি ঘৃণাভাষণ দিয়েছেন।
শুধু রাজনীতিবিদ নয়, ২ জন বিচারক ও ১ জন রাজ্যপালও জাতিসংঘের রাবাত প্ল্যান অনুযায়ী ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, মাত্র ১৩% ঘৃণাজনিত অপরাধের ঘটনায় এফআইআর দায়ের হয়েছে—যা প্রমাণ করে যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি এই ধরণের অপরাধকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
প্রতিবেদনটি স্পষ্ট করে যে, বিজেপি সরকারের তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছর জুড়ে ঘৃণার স্বাভাবিকীকরণ ঘটেছে—রাজনৈতিক ভাষণেও, রাস্তায়ও। ভারতের আইনি কাঠামোতে ধর্মীয়ভাবে প্ররোচিত ঘৃণাজনিত অপরাধ দমনের জন্য কোনও পৃথক আইন নেই, এবং আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা আরও উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
সৌজন্যেঃ India Tomorrow
COMMENTS