রম্যরচনা : সব চরিত্র কাল্পনিক মুদাসসির নিয়াজ অনেকে বলে, এই পৃথিবীতে টাকাই সব। টাকা না থাকলে শব। কেউ বলে, মানি ইজ হানি। আবার কেউ কেউ বলে,...
রম্যরচনা:
সব চরিত্র কাল্পনিক
মুদাসসির নিয়াজ
অনেকে বলে, এই পৃথিবীতে টাকাই সব। টাকা না থাকলে শব। কেউ বলে, মানি ইজ হানি। আবার কেউ কেউ বলে, টাকা দৈনন্দিন জীবনের ৯০ শতাংশ প্রয়োজন মেটায় বা সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। কেউ কেউ আবার বলেন, টাকা মাটি মাটি টাকা। কেউবা বলেন, অর্থই অনর্থের মূল। টাকার গদিতে শুয়ে থাকা লোকেরা এসব কথা শুনে বলে, আঙুর ফল টক। তাদের যুক্তি হল, ট্যাঁকের জোর না থাকলে নীতিকথা বলে সাফাই দেয়।
অনেকে বলে, ‘টাকা’ নাকি সেকেন্ড গড। কেউ কেউ বলেন, টাকা থাকলে বাঘের চোখও পাওয়া যায়। টাকায় কী না হয়? টাকায় টাকা বাড়ে। টাকার জন্য কত মানুষ কত কী না করে। আবার টাকার গরমেও মানুষ অনেক কিছু করে। টাকা মানুষের ভোল বদলে দেয়। টাকার মাথায় বুড়োরও বিয়ে হয়। কৃপণ লোককে সবাই টাকা ধার দিতে সংকোচ করে, পাছে আমেশা হাগিয়ে ছাড়ে! টাকার এতই ক্ষমতা। আসলে টাকা আর ক্ষমতা পরস্পরের পরিপূরক। ক্ষমতার উৎসই হল টাকা।
কিন্তু এটাও ঠিক যে, পর্যাপ্ত টাকা থাকলে আমরা বাঙালিরা দীপু-দা হয়ে থাকতাম না। উইকেন্ডে সুইৎজারল্যান্ড, কানাডা, হংকং যেতাম। টাকা থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েরা গ্রামের স্কুলে নিশ্চয় পড়ত না। চারচাকা চড়ে লরেটো, জেভিয়ার্স ইত্যাদি ইংলিশ মিডিয়ামে যেত। টাকা থাকলে এ রকম অনেক কিছুই ১৮০ ডিগ্রি বদলে যেত। টাকা না থাকায় আমরা পকেটের দাসত্ব করি। পকেট যতখানি পারমিট করে ততখানি এগোই। অর্থাৎ সবসময় আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়। ছেলেপুলেদের আবদার মেটানোর সামর্থ্য না থাকলে আক্ষেপ করে বলি, টাকার গাছ আছে নাকি ?
গিন্নির আবদারে কালেভদ্রে হোটেল রেস্টুরেন্টে গেলে সবার আগে মেনু কার্ডের ডানদিকের গাণিতিক সংখ্যাগুলোর দিকে চোখ চলে যায়। তারপর পুষ্টিবিদ হয়ে গিয়ে যুক্তির জাল বুনে সাফাই দিয়ে বলি, তোমার পছন্দের খাবারটা কত না ক্ষতিকর। আসল কথা হল আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকায় আমরা কম্প্রোমাইজ লাইফ লিড করি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, টাকার জন্য জীবন, নাকি জীবনের জন্য টাকা? টাকা আমাদের বহন করছে, নাকি আমাদের বাহনে পরিণত হয়েছে?
টাকার জন্যই বিত্তশালী লোকদেরকে সবাই সমীহ করে, সম্মান করে। টাকা না থাকলে তারা এত বেশি সম্মান-মর্যাদা হয়ত পেত না। কিন্তু এত বিপুল ঐশ্বর্য্য-বৈভবের মালিক তারা কীভাবে হলো, সেই রহস্য উন্মোচনে কেউ তালাশ করে না। টাকা হলেই সব পাওয়া যায়। টাকার কাছে শিক্ষা, বিবেক, মানবতা, মনুষ্যত্ব, নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই। এখন টাকাই মুখ্য, বাকি সব গৌণ।
যার টাকা আছে, সে গৌরী সেন, বাকি সব হাইফেন। তাই টাকা ধ্যান, টাকা জ্ঞান, টাকা চিন্তামণি। টাকা বিনা ওরা যেন মণিহারা ফণি। বাংলা ব্যান্ডের গানে আক্ষেপ রয়েছে, "হয় দেখা দে, নয় টাকা দে"। "মাথা ভরা টাক দিলি, আকার দিলি না।" নচিকেতার গানে আছে, "টক টক টকটরে টাক্কা, টাক্কায় চলে পৃথিবীর চাক্কা।" টাকা নিয়ে কবিতা, গল্প, নাটক কতকিছু রয়েছে। টাকাকে আবর্তিত করে ঘুরছে কতকিছু।
একজন বিবেকবান বা চরিত্রবান মানুষের বর্তমান সমাজে কোনো মূল্য নেই, যদি তার টাকা না থাকে। সমাজ তার নিজস্ব রূপ-চরিত্র বদলে ফেলেছে। টাকার কাছে ‘সমাজ’ নির্বিকার, নিধিরাম সর্দার। অনেকের কাছে আবার টাকাই খোদা (নাউজুবিল্লাহ)। টাকার প্রতি আমরা প্রায় সবাই কমবেশি ভক্তি-শ্রদ্ধায় গদগদ। আগেকার দিনে দেখা যেত, যে অসৎ বা অবৈধ পথে উপার্জনকারী জনৈক ব্যক্তির বাড়িতে সচরাচর আলেম বা মসজিদের ইমামরা দাওয়াত খেতে যেতেন না।
এখন সেই চাকা উল্টোদিকে ঘোরে। সুদের টাকায় কত লোক বছর বছর হজ-উমরাহ করছে। মসিজদের সম্পত্তি বেমালুম হজম করে ফেলছে। মসজিদ-মাদ্রাসার নাম করে টাকা তুলে পকেট ভরাচ্ছে। যাকাতের টাকায় গাড়ি-বাড়ি বানাচ্ছে। ষোলআনা কমিটি বা মসজিদ ফান্ডে মোটা টাকা দিলে সেই দু-নম্বরী লোকটাকেই কমিটির মাথায় বসানো হয়। টাকার কাছে সবকিছুই বিকিয়ে যাচ্ছে।
ফেলো কড়ি, মাখো তেল – এটাই এখন অঘোষিত নিয়মে পর্যবসিত হয়েছে। চাকরি পেলে ঘুষ খাওয়া বা পাওয়া যায়, নিদেনপক্ষে ভবিষ্যত পাক্কা। মাইনের দরকার নেই, ঘুসের টাকাতেই তিন পুরুষ বসে খাওয়া যাবে। তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক ঠাকুরের দোর ধরে একটিবার শিকে ছিঁড়লে ধরাকে সরা জ্ঞান করে অনেকেই। সরকারি চাকরি মানে হল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। তাই জমিজমা, সোনা-গহনা বিক্রি করে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে মানুষ চাকরির পিছনে পড়ে থাকে। চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করে, তীর্থের কাক হয়ে জোঁকের মতো লেগে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম থাকলেও খুঁটি এবং ঘুঁটির জোর থাকা চাই। খুঁটি মানে ন্যাতা-মন্ত্রী, আর ঘুঁটি মানে টংকা। এই দুটো সমান্তরালভাবে না থাকলে যতই মেধা থাক, যত ভালই রেজাল্ট থাক, কোনো মূল্য নেই।
বেশিরভাগ অফিসে টাকার বান্ডিল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। অবশ্য ইদানীং আবার চাকরি পাবার থেকে চাকরি চলে যাচ্ছে অনেকের। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই। অগত্যা আমাদের মতো শিক্ষিত বেকার যুবকদের এটাই সান্ত্বনা পুরস্কার। আমরা তো বেচারা অমলকান্তির মতো রোদ্দুর হতে চাইনি, চেয়েছিলাম নিদেনপক্ষে একটা কেরানির কাজ। তাও জোটেনি ফুটো কপালে।
বলাবাহুল্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আজ একেবারেই তলানিতে পৌঁছেছে। যাদের নীতি-নৈতিকতাবোধ রয়েছে তারা নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় রয়েছেন। অনৈতিকতার প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে পারছেন না; প্রতিবাদ করতে গিয়ে টার্গেট হয়ে যাচ্ছেন, এই ব্যর্থতার গ্লানি বুকে নিয়েই অতিকষ্টে তাদের দিন কাটছে। মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষ দেওয়া নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ‘সদা সত্য কথা বলব’ – এ কথা কি শুধু পাঠ্যবইয়েই সীমাবদ্ধ ও লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে? কেবল সংবিধানেই বিধিবদ্ধ হয়ে শোভা বর্ধন করবে? বাস্তবায়ন কী হবে না?
বলা হয়, সরকারি অফিসগুলোর ইট-কাঠ-পাথর পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো হাঁ করে থাকে টাকার জন্য। প্রতি পদে বাড়তি টাকা দেওয়াটা যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ব্যাপারটা সবার গা সওয়া হয়ে গেছে। কেউ কিছু মনে করে না। ঘুস আর ডোনেশন মুদ্রার ওপিঠ-ওপিঠ। দুর্নীতি মুড়ি-মুড়কির মতো হয়ে গেছে। এমন কোনো দফতর বা অফিস নেই, যেখানে ঘুসের রমরমা নেই। ঘুস না দিলে ৩৬ মাসেও লাল ফিতের ফাঁস খোলে না। টাকা না ফেললে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে যেতে যেতে একটা ফাইল বুড়িয়ে যায়। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জুতোর সোল ক্ষয়ে যায়।
অথচ দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ এ দেশে পিপড়ের মত পিল পিল করছে, পোকা মাকড়ের মতো কিলবিল করছে। আর দেশ ক্রমেই ঋণভারে ডুবে যাচ্ছে। গড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্মাচ্ছে প্রতিটা শিশু। তাহলে এই দেশ কোন জাদুমন্ত্র বলে শিশুর বাসযোগ্য হবে? ব্যাঙ্কগুলো তো একে একে দেউলিয়া হয়ে ঝাঁপবন্ধ করে দিচ্ছে, অথবা অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে মার্জ করে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ধার করে ঘি খেয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন লাটসাহেবরা।
লাটেরবাঁট সরকার বাহাদুর দেশপ্রেমের নয়া সংজ্ঞা ও তার প্রয়োগ নিয়েই ব্যস্ত। দেশ উচ্ছন্নে যাক, তা নিয়ে বিন্দু মাত্র হেলদোল নেই। কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক দেশবাসীকে ১৫ লাখ করে দেওয়া হবে বলে জিরো ব্যালেন্সে জনধন যোজনায় অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে গরিবগুর্বোদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকাগুলো নিয়েও চম্পট দিল মালিয়া, মোদি, চোকসি-সহ প্রায় আড়াই হাজার লুম্পেন শিল্পপতি। আর বড়বাবু বলছেন, উনি নাকি চৌকিদার। ওনার ভয়েই নাকি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে সব।
টাকা মারলে কারাগারের কুঠুরিতে বসে হিরোইন থেকে হেরোইন সব পাওয়া যায়। অথচ অধিকাংশ সরকারি অফিস-কাছারিতেই সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। তবুও তাকে থোড়াই কেয়ার করে বাবু সাহেবরা টেবিলের তলা দিয়ে দিব্যি হাত বাড়ান।
আমার মতো একজন নিতান্ত আটপৌরে মানুষ এতসব কিসসা কাহিনি জানেন। আর দেশের নেতা-মন্ত্রীরা জানেন না? – একথা শুনলে তো ঘোড়াতেও হাসবে। আমরা হলাম সেই সভ্যদেশের সচেতন নাগরিক। সত্য ফিসফাস, কী বিচিত্র এই দেশ। তবু বলতে হয় মেরা ভারত মহান, সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা।
আমাদের দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের (বিধায়ক, সাংসদ)-দের অর্ধেকেরও বেশি নারী পাচার, খুন, ধর্ষণ, দাঙ্গা, নাশকতা ইত্যাদি প্রভৃতি ভয়ঙ্কর সহ ফৌজদারী মামলার সঙ্গে জড়িত। তারা আমাদের রাজ্য তথা দেশের কাণ্ডারী।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা বাগিচা ধ্বংস করতে একটা পেঁচাই যথেষ্ট। কিন্তু সেই বাগিচার প্রতিটা গাছের প্রতিটা ডালে যদি একটি করে পেঁচা বসে থাকে, তাহলে তো তেরাত্তির পার হবে না সেই বাগিচা গালিচায় পরিণত হবে।
কিন্তু মুসলমান হিসাবে শুধু রোজগার করলেই হবে না। হারাম হালাল সমঝে চলতে হবে। সৎ পথে রোজগার করলেই হবে না। সঠিক মাত্রায় যাকাত আদায় করতে হবে, না হলে সেই রোজগার হালাল হিসেবে আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। তাই আমাদেরকে আমাদের উপার্জন নিয়ে শেষ বিচার দিবসে জওয়াব দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করা করা হবে, কোন পথে আয় করেছো এবং কোন পথে ব্যয় করেছো? অতএব, সাবধান। রোজগার হালাল না হলে কোনো ইবাদত কবুল হবে না।
অসাধারণ
উত্তরমুছুন