উপসম্পাদকীয়: আমেরিকা কি যুক্ত হবে ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত বহুদিন ধরে। জবরদখলকারী ইজরায়েল গাজার নাগরিকদের হত্যা করে গাজা ...
উপসম্পাদকীয়:
আমেরিকা কি যুক্ত হবে
ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধে
মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত বহুদিন ধরে। জবরদখলকারী ইজরায়েল গাজার নাগরিকদের হত্যা করে গাজা দখল করার জন্য ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। এরই পাশাপাশি নিজের উন্নত প্রযুক্তির অহংকারে ইরানের পরমাণু প্রযুক্তি স্থাপনা লক্ষ্যে করে হামলা করলে যোগ্য জবাব দেয় ইরান। এখন এই পরিস্থিতিতে যদি আমেরিকাকে ইজরায়েল পাশে না পায় তবে ইজরায়েলের অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে পড়বে। কারণ ইরান ইজরায়েলের গর্ব আয়রন ডোম চূর্ণ করে তেল-আবিব ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
রাকিবুল ইসলাম
ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ এবং আমেরিকার জড়িয়ে পড়া একটি জটিল ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু। এটি বোঝার জন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন দেশের কৌশলগত স্বার্থ বিবেচনা করা জরুরি।
দীর্ঘ দিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্ত। ফিলিস্তিনকে কবরে পরিণত করেছে জবরদখলকারী ইজরায়েল। গাজা অবরুদ্ধ করে রাখা অবস্থায় ইজরায়েল ইরান আক্রমণ করে বসে। কোন প্ররোচনা ছাড়া এমন আক্রমণ অতি আত্মবিশ্বাস বলে অনেকে মনে করছেন। পরমাণু শক্তিধর ইরান ইজরায়েলের আক্রমণের উপযুক্ত জবাব দিতে থাকে।
•দু-দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ইরান ও ইজরায়েলের শত্রুতা বহু দশকের পুরোনো। ১৯৭৯ সালের ইরানী ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরান ইজরায়েলকে ‘অবৈধ রাষ্ট্র’ বলে আখ্যায়িত করে এবং ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানিয়ে আসছে।
ইজরায়েলও ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে, বিশেষত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে।
আমেরিকার ভূমিকা:
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা ইজরায়েলকে সামগ্রীক সামরিক ও কুটনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। বিশেষত আমেরিকার সহোযোগিতা ছাড়া ইজরায়েলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অনেকটাই কঠিন। ইরানের আক্রমণে অনেকটাই দিশেহারা ইজরায়েল বিভিন্নভাবে চাইছে আমেরিকা সরাসরি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামুক। ইরানের হামলার পরে ইজরালের জনগণ দাবি জানায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তাদের রক্ষার জন্য। যে কারণে আমেরিকা ইজরায়েলের পাশে থাকবে:
১. ইস্রায়েলের প্রধান মিত্র:
আমেরিকা ইস্রায়েলকে বিশাল সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। প্রতি বছর বিলিয়ন ডলার মূল্যের সাহায্য দেয় এবং তাদের ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।
২. ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ও চাপ:
আমেরিকা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে দীর্ঘদিন ধরেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে।
২০১৫ সালের JCPOA (Joint Comprehensive Plan of Action) থেকে ট্রাম্প প্রশাসন ২০১৮ সালে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়। বিভিন্ন ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখার জন্য ইরানের মত একটা রক্ষণশীল দেশ যাতে পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে না উঠতে পারে তার সবরকম চেষ্টা বরাবর করে আসছে আমেরিকা।
৩. মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক উপস্থিতি:
আমেরিকার বহু সামরিক ঘাঁটি রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, এবং ইরাকে। মূলত: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাতে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে সেজন্য আমেরিকা ঘাঁটি গেড়ে আছে বিভিন্ন দেশে। এ ব্যাপারে আমেরিকা পেরে ওঠেনি ইরানের সঙ্গে।
ইরান-ইস্রায়েল যুদ্ধের সম্ভাব্য বিস্তার রোধে এবং নিজের মিত্রদের রক্ষা করতে আমেরিকা সেখানে সামরিক শক্তি সুযোগমতো ব্যবহার করতে পারে।
৪. ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা:
ইরান মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে সমর্থন দেয় যেমন: হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুথি (ইয়েমেন), এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন গোষ্ঠী।
আমেরিকা এই গোষ্ঠীগুলিকে 'সন্ত্রাসী সংগঠন' হিসেবে দেখিয়ে মাঝে মাঝে ড্রোন হামলা বা বিমান হামলা পরিচালনা করে। যদি ইরান মধ্যপ্রাচ্যের একটা ক্ষমতাধর দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে সমর্থ হয় তবে আমেরিকার মাতব্বরি কিছুটা হলেও খর্ব হবে। সেজন্যে কোন অবস্থায় আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে দেবে না।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আমেরিকার অবস্থান কেমন হতে পারে:
ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধে আমেরিকা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে কিনা এটা লাখ টাকার প্রশ্ন। তবে অনেকটা মাথা গরম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা প্রবল। দীর্ঘদিন ধরে পরমাণু প্রযুক্তি তৈরির প্রচেষ্টা রুখতে আমেরিকা ইরানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। এখন ইজরায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানকে শায়েস্তা করার একটা সুযোগ পেল যুদ্ধবাজ আমেরিকা। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ একটা চাপ তার উপরে আছে। দেশের জনগণের একটা বড় অংশ যুদ্ধের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসন যাতে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক করছে। এখন পরিস্থিতি ট্রাম সরকারের কাছে চ্যালেঞ্জিং। সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে এ বিষয়ে সকলে মোটামুটি একমত।
যদি আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে:
আমেরিকা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে চিন রাশিয়ার মত দেশ গুলো ইরানের পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এখনও যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে এ বিষয় স্পষ্ট ইরানকে তারা সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। যদি সরাসরি আমেরিকা ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে নামে সেক্ষেত্রে চিন রাশিয়ারও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা অবশ্যই থাকবে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো যদি আমেরিকার পক্ষ ত্যাগ করে তবে বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রবল।
আমেরিকা মূলত ইস্রায়েলের নিরাপত্তার গ্যারান্টার হিসেবে কাজ করে এবং একইসঙ্গে ইরানের প্রভাব ঠেকাতে চায়। তবে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা বিশাল আকার ধারণ করতে পারে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্য ও বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে সব কথার শেষ কথা। সবার আগে আমেরিকা নিজের স্বার্থের কথা ভাববে। তবে যদি সরাসরি আমেরিকা এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তবে ফল ভয়াবহ হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
COMMENTS