সম্পাদকীয়: সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য শাসকের ছত্রছায়ায় চারিদিকে শুধু হতাশার ছবি। অপরাধ করে সাত খুন মাফ যদি শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় ন...
সম্পাদকীয়:
সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য শাসকের ছত্রছায়ায়
চারিদিকে শুধু হতাশার ছবি। অপরাধ করে সাত খুন মাফ যদি শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেওয়া যায়। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা ক্রমাগত নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। দেশ তথা রাজ্যের পরিবর্তনের জন্য এই নৈরাজ্যের অবসান জরুরী।
বর্তমান বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক গভীর উদ্বেগজনক প্রবণতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে—শাসক দলের ছত্রছায়ায় সমাজবিরোধীদের দাপট বাড়ছে এবং প্রশাসন তা ঠেকাতে কার্যত ব্যর্থ। এই পরিস্থিতি শুধু আইনের শাসনকে দুর্বল করছে না, বরং গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোকে আঘাত করছে গভীরভাবে।
রাজনৈতিক দলের ভিতর যখন আদর্শ ও নীতির চর্চার বদলে ক্ষমতার লোভ এবং অপরাধীদের প্রশ্রয় প্রাধান্য পায়, তখন তা শুধু দলের পতনের বার্তা দেয় না, সমাজের জন্যও এক দীর্ঘমেয়াদি বিপদের জন্ম দেয়। বাংলার একাধিক জেলায়, বিশেষ করে পঞ্চায়েত ও পুরসভা নির্বাচনের সময় কিংবা টেন্ডার বিতরণ, জমি দখল এবং অনুদান বণ্টনের ক্ষেত্রে এক শ্রেণির ‘দলীয় পরিচয়ধারী’ সমাজবিরোধীদের দাপট চোখে পড়ার মতো।
প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে এমন সব ঘটনা, যেখানে কোনো শাসকদলঘেঁষা নেতা বা কর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মারধর, এমনকি খুন ও ধর্ষণের অভিযোগ উঠছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, অভিযুক্তরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। এই ‘রেহাই সংস্কৃতি’ই আজ দৌরাত্ম্যের অন্যতম প্রধান উৎস।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রশাসনের একাংশের নির্লিপ্ততা। পুলিশের ভূমিকা বহু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। রাজনৈতিক নির্দেশে বা প্রভাবের ভয়ে অনেক অপরাধ রেকর্ডই হয় না, অথবা যথাযথ তদন্তের অভাবে বিচারের মুখ দেখে না। এর ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
শাসক দলের সমাজবিরোধীদের রমরমা কেবল অপরাধমূলক কার্যকলাপেই সীমাবদ্ধ নয়, বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডেও বাধা সৃষ্টি করছে। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচার—সব ক্ষেত্রেই বিরোধীদের হেনস্থা, হামলা, মামলার ঘটনা ঘটছে। এতে সাধারণ মানুষ বিরক্ত, ভীত এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে।
এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজ্য যে এক নৈরাজ্যের দিকে এগোচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল—আইনের শাসন, ন্যায়বিচার এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সমাজবিরোধীদের আধিপত্য এবং প্রশাসনিক নিস্ক্রিয়তা এই তিনটি স্তম্ভকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এখনই সময়, শাসক দল নিজেদের মধ্যে আত্মসমালোচনার পরিবেশ তৈরি করুক। আদর্শগত ও নৈতিক শুদ্ধিকরণের পথে না হাঁটলে যে আস্থা তারা জনতার মধ্যে তৈরি করেছিল, তা দ্রুত ভেঙে পড়বে। অপরাধীদের দল থেকে বিতাড়িত করা, প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং বিরোধী মতকে সম্মান করার সংস্কৃতি পুনরুদ্ধার করাই সময়ের দাবি।
বাংলা বহু আন্দোলন ও পরিবর্তনের সাক্ষী। গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের চর্চা এই রাজ্যের ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্য রক্ষায় সকল রাজনৈতিক শক্তির দায়িত্ব আছে। সমাজবিরোধীদের শাসনে নয়, গণতন্ত্রের শাসনেই ভবিষ্যতের বাংলা গড়ে উঠুক—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
COMMENTS