বিশেষ প্রতিবেদন: এই দেশ বিহারে পেছনের দরজা দিয়ে এনআরসি? ভোটার তালিকা সংশোধনে জন্ম সনদের দাবি নিয়ে বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা সামি আহমদ, পাট...
বিশেষ প্রতিবেদন: এই দেশ
বিহারে পেছনের দরজা দিয়ে এনআরসি? ভোটার তালিকা সংশোধনে জন্ম সনদের দাবি নিয়ে বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা
সামি আহমদ, পাটনা:
বিহারে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য জন্ম সনদ চাওয়াকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে, এটি আসলে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC)-এর গোপন প্রয়োগ।
যেখানে দিল্লি ও অন্যান্য রাজ্যে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য যেকোনো একটি পরিচয়পত্র যথেষ্ট—যেমন জন্ম সনদ, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, দশম বা দ্বাদশ শ্রেণির সনদ (যদি জন্মতারিখ থাকে), কিংবা ভারতীয় পাসপোর্ট—সেখানে বিহারে নির্বাচন কমিশন (ECI) বিশেষ নিবিড় সংশোধন অভিযান (Special Intensive Revision - SIR) শুরু করেছে, যেখানে এমন সব কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে যা বহু দরিদ্র, দলিত, মুসলিম ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের পক্ষে সংগ্রহ করা কঠিন।
এই অভিযানের নিয়ম অনুযায়ী:
১ জুলাই ১৯৮৭’র আগে জন্ম হলে: নিজের জন্ম সনদ
১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৪ এর মধ্যে জন্ম হলে: নিজের ও এক পিতামাতার জন্ম সনদ
২ ডিসেম্বর ২০০৪’র পরে জন্ম হলে: নিজের ও দুই পিতামাতার জন্ম সনদ
তীব্র বিরোধিতার মুখে নির্বাচন কমিশন এই নিয়ম কিছুটা শিথিল করেছে। এখন যদি আবেদনকারীর একজন পিতা/মাতা ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় থাকেন, তবে আলাদা করে জন্ম সনদ দিতে হবে না। তবে এই নতুন শর্ত পূরণ করাও দরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগণের পক্ষে কঠিন। এর ফলে বহু মানুষের ভোটাধিকার হরণের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জনগণের মধ্যে ক্ষোভের অন্যতম কারণ হলো, আধার, রেশন কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, প্যান কার্ড, এমজিএনআরইজিএ কার্ড ইত্যাদি নাগরিকত্ব বা বসবাসের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানানো হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কেবল ভারতীয় নাগরিক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় ১৮ বছর বয়সের উপরে বসবাসকারী ব্যক্তিই ভোটার হতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগে যখন আধার ও অন্যান্য পরিচয়পত্রে ভোটার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হতো, তখন হঠাৎ নতুন নিয়ম কেন, যা বহু মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে?
বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন শাসকজোট (এনডিএ), বিশেষ করে জেডিইউ নেতা মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও বিজেপির চাপে এই নিয়ম জারি করেছে, যাতে দলিত, মুসলিম ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ভোট বাদ পড়ে যায়। এই জনগোষ্ঠীর বড় অংশ বিজেপি ও জেডিইউকে ভোট না দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এই নতুন নিয়ম শাসকজোটকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে।
এই ইস্যুতে বিহারে রাজনৈতিক ঝড় উঠেছে। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন এই অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ভারতের বিরোধী জোট (INDIA Bloc) এই ‘বিশেষ সংশোধন অভিযান’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তাদের অভিযোগ, ভোটার বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র, সন্দেহজনক সময় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করা হয়েছে।
বিরোধী দলসমূহ—ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (INC), রাষ্ট্রীয় জনতা দল (RJD), তৃণমূল কংগ্রেস (TMC), সিপিআই(এম), সিপিআই(এমএল), এবং এআইএমআইএম—নানা অভিযোগ এনেছে।
আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই নতুন নিয়ম দরিদ্র, দলিত, মুসলিম, পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও মাইগ্রান্ট শ্রমিকদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে। সিপিআই(এম) নেতা নিলৎপাল বসু বলেন, যারা কাজের কারণে বাইরে আছে, তারা ফিরে এসে কাগজপত্র জমা দিতে পারবে না, ফলে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে।
এই বিতর্কিত SIR ঘোষণা করা হয় ২৪ জুন ২০২৫ তারিখে, কার্যকর হয় ২৫ জুন থেকে এবং চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ। হঠাৎ এই ঘোষণায় মাত্র তিন কোটিরও বেশি ভোটারের যাচাই করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তেজস্বী যাদব প্রশ্ন তোলেন, ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পর এই সংশোধনী প্রক্রিয়া কেন নেওয়া হয়নি? কেন এখন এত তাড়াহুড়া?
তিনি বলেন, “নীতিশ কুমার ও এনডিএ-এর সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করেই দরিদ্র, শোষিত, সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসীদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন কমিশন একদিকে ভোটার আইডি ও আধার সংযোগের কথা বলছে, অথচ এখন আধারকেই নাগরিকত্ব প্রমাণ হিসেবে মানা হচ্ছে না – এটা হাস্যকর।”
বিরোধীদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন এই অভিযানের আগে তাদের কোনো পরামর্শ নেয়নি। কমিশনের দাবি, বুথ স্তরের এজেন্ট (BLA) মাধ্যমে তারা পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে। সিপিআই(এমএল) নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচন কমিশন দিল্লির মিটিংয়ে কেন এই প্রসঙ্গ আনেনি?
তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই অভিযানের তুলনা এনআরসির সঙ্গে করে বলেন, এটি ‘ব্যাকডোর এনআরসি’, যা পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও কেরালার মতো রাজ্যেও প্রয়োগের পথ প্রশস্ত করতে পারে।
তারা বলেন, ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আগে যে স্বঘোষণা (Form 6) ও আধার যথেষ্ট ছিল, সেখানে এখন জন্মসনদের মতো কঠিন ডকুমেন্ট চাওয়া হচ্ছে—এটি আইনবিরোধী ও অসাংবিধানিক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এটি এনআরসির চেয়েও বেশি বিপজ্জনক ‘স্ক্যাম’। কংগ্রেস নেতা পবন খেরা অভিযোগ করেন, “এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হচ্ছে।” AIMIM প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানান, “এই বিশেষ নিবিড় সংশোধন আইনি দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রকৃত ভোটারদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে পারে।”
সৌজন্যেঃ Indian Tomorrow
COMMENTS