উপসম্পাদকীয়ঃ হিন্দী বলয়ে বাংলাভাষীদের বিতাড়ন ভাষা নয়, যেন একটা জাতির পরিচয় মুছে দেওয়ার এক নীরব ষড়যন্ত্র বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগ...
উপসম্পাদকীয়ঃ
হিন্দী বলয়ে বাংলাভাষীদের বিতাড়ন
ভাষা নয়, যেন একটা জাতির পরিচয় মুছে দেওয়ার এক নীরব ষড়যন্ত্র
বিশেষত বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বাংলা ভাষীদের বাংলাদেশী তকমা দিয়ে উপর চরম বিদ্বেষ এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। এমনও হয়েছে বৈধ পরিচয়পত্র থাকার পরও পুশব্যাক করা হয়েছে বাংলাদেশে। বর্ডারে কড়া নিরাপত্তা থাকার পরও বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশী!
“ভাষা একটি জাতির আত্মা।” এই চিরন্তন সত্য যখন আজ বাংলাভাষার অস্তিত্বের প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন তা কেবল একটি ভাষাকে নয়—একটি ঐতিহ্য, একটি সভ্যতাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। হিন্দী বলয়ের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষদের প্রতি যে অব্যক্ত বিদ্বেষ, প্রশাসনিক নিপীড়ন এবং সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, তা নিছক বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়—এ এক গভীর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ইঙ্গিত। একটা ভূখণ্ডের বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের তাদের ভাষাগত ঐতিহ্যকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আজ যদি বাংলাভাষাকে টার্গেট করা হয় তো আগামীকাল উর্দুকে টার্গেট করা হবে।
ভবঘুরে নয়, শ্রমজীবী নাগরিক এই বাংলাভাষীরা
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি—এইসব অঞ্চলে কর্মসূত্রে প্রচুর বাংলাভাষীদের বাস বহু প্রজন্ম ধরে। তাঁরা কেবল নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী কিংবা হকারই নন—আছেন শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি কর্মচারী, এমনকি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকও। কিন্তু আশঙ্কার বিষয়, এখন তাঁদের উপস্থিতিকে বহিরাগত বা অবাঞ্ছিত হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দী বলয়ের বহু জায়গায় বাংলাভাষী পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে দোকান উচ্ছেদ, বাড়িতে দখলদারি, ভাষাভিত্তিক বিদ্বেষ ছড়ানো এবং বাংলা ভাষার চিহ্ন মুছে ফেলার এক নিষ্ঠুর প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাংলা নামফলক অপসারিত হচ্ছে, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রশাসনিক পদক্ষেপও দেখা যাচ্ছে।
ভাষা নিয়ে রাজনীতির নির্মম বাস্তবতা
ভারতবর্ষে ভাষা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে অনেক আগেই। আজ সেই অস্ত্র আরও ধারালো করে ব্যবহার করা হচ্ছে। "এক দেশ, এক ভাষা, এক জাতি"—এই স্লোগানের ছায়ায় কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণি হিন্দীকে জাতীয় পরিচয় হিসাবে চাপিয়ে দিতে চাইছে। সেই লক্ষ্যে দেশের নানা প্রান্তে আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে কোণঠাসা করা হচ্ছে—তামিল, কন্নড়, ওড়িয়া, অসমিয়া ভাষার পাশাপাশি এখন সরাসরি আঘাত হানা হচ্ছে বাংলাভাষার উপরেও।
এই ভাষানীতির শিকার কেবল ভাষা নয়—এর সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতি, ইতিহাস, আত্মপরিচয়। বাংলাভাষার ক্ষেত্রে তা আরও গভীর, কারণ এটি ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তির সংগ্রামের অংশ। এই ভাষাকে নিঃশেষ করার মানেই হচ্ছে গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদের আত্মাকে আঘাত করা। সাংবিধানিক অধিকারকে সংকুচিত করার এক ভয়ঙ্কর অপচেষ্টা চলছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে।
প্রশ্ন উঠছে: রাষ্ট্র কি নিরপেক্ষ?
ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে বাংলা একটি স্বীকৃত ভাষা। তা সত্ত্বেও হিন্দী বলয়ের রাজ্যগুলোতে বাংলাভাষীদের নাগরিক অধিকার খর্ব হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রশাসনের নিরবতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনীহা, এবং মিডিয়ার অবহেলা পরিস্থিতিকে আরও ঘনীভূত করেছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্র কি সত্যিই সংবিধান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ? নাকি ভাষার নামে এক অস্থির দেশ প্রতিষ্ঠার অভিযানে সে নিজেই সক্রিয়? বাংলাভাষীদের এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও কার্যকর উদ্যোগ আজও দেখা যায়নি, বরং হিন্দী আধিপত্যের নীতিই ক্রমে প্রতিষ্ঠা দিয়ে চলছে।
প্রতিরোধই উত্তরণ: যা করণীয় এখনই
বাংলাভাষার অস্তিত্ব আজ যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা মোকাবিলায় প্রয়োজন সংগঠিত ও সচেতন প্রতিরোধ।
১. স্থানীয় সংগঠনগুলির সংহতি গড়ে তোলা: দিল্লি, মুম্বাই, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. আইনি লড়াই শুরু করা: বাঙালি শ্রমিকদের বিতাড়ন, ভাষাভিত্তিক বৈষম্য, উচ্ছেদের মত কাজের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়া প্রয়োজন। সংবিধান অনুযায়ী প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক তার ভাষাগত অধিকার এবং একজন দেশের নাগরিক হিসেবে সার্বিক সুরক্ষা যাতে পেতে পারে তার জন্য সার্বিক আইনগত সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. মিডিয়া ও সাহিত্যিকদের সক্রিয়তা: এই সাংস্কৃতিক নিধনের চিত্র গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে। বাংলা ভাষার সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিকদের আরও বেশি সচেতন ও সংবেদনশীল ভূমিকা গ্রহণ জরুরি। প্রত্যেক ভারতবাসীকে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশের বৈচিত্র্যের মধ্যে যে ঐক্য তা জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য কলম ধরতে হবে।
৪. পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সরকারের দৃঢ় অবস্থান: বাংলাভাষা রক্ষায় এই দুই রাজ্যকে জাতীয় পর্যায়ে জোরালো অবস্থান নিতে হবে। এটি কোনো এক রাজ্যের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়—এটি সমগ্র বাংলা জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।
উপসংহার: ভাষার উপর আঘাত মানে জাতির উপর আঘাত
বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ভারতের ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আজ সেই জনগোষ্ঠী যদি নিপীড়নের শিকার হয়, তবে তা গোটা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের পরিচয়। এটি কেবল মুখের ভাষা নয়—এটি মায়ের ভাষা, বিদ্রোহের ভাষা, সৃষ্টির ভাষা। সেই ভাষার উপর আঘাত সহ্য করা মানে আত্মঘাতী হওয়া। তাই এখনই সময়—ঘরে ঘরে, শহরে শহরে বাংলাভাষীদের অধিকার, সম্মান ও অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন গড়ে তোলার। ভাষার জন্য আমাদের পূর্বসূরিরা জীবন দিয়েছেন, আমরা কি তাদের উত্তরসূরি হয়ে শুধু নীরব থেকে যাব?
COMMENTS