ফিচার: বেঙ্গালুরুর রয়্যালস্টেট "ডান্সিং অন দ্ গ্রেভ: শাকেরাহ খলিলির প্রেম, প্রতারণা ও করুণ মৃত্যু – এক সত্যিকারের রাজকুমারীর বেদনাময...
ফিচার: বেঙ্গালুরুর রয়্যালস্টেট
"ডান্সিং অন দ্ গ্রেভ: শাকেরাহ খলিলির প্রেম, প্রতারণা ও করুণ মৃত্যু – এক সত্যিকারের রাজকুমারীর বেদনাময় গল

করুণ পরিনতি স্বীকার কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর পার্সিয়ান মুসলিমপরিবারে ধনাঢ্য সুন্দরী শিক্ষিতা শাকেরাহ। জীবন্ত পুঁতে ফেলল দ্বিতীয় স্বামী সন্ন্যাসী বেশধারী শ্রদ্ধানন্দ!
এই ফিচার আর্টিকেল লিখেছেন মোঃ রাকিবুল ইসলাম ।
২৮শে এপ্রিল, ১৯৯১, এক লোমহর্ষক ঘটনার মৌন সাক্ষী কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর রয়ালস্টেট। একজন আবাসন উন্নয়ন উদ্যোক্তা ও সমাজসেবী, ৬০০ কোটির মালকিন শাকেরাহ খলিলির নৃশংস খুন। এই হাড় হিম করা লোমহর্ষক কাহিনী পড়লে হয়তো অনেকেই ঘুম ছুটে যেতে পারে।
আসুন আমরা জেনে নিই কে এই শাকেরাহ।১৯৪৭ গত ২৭ আগস্ট মাদ্রাজে একটি ভারতীয়-পার্সিয়ান মুসলিমপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারটি ১৯০০ গোড়ার দিকে সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা ছিল যেখানে শাকেহ স্কুল জীবন কাটে।
তিনি ছিলেন গুলাম হোসেন নামাজী এবং গওহর তাজ বেগম নামাজী মহীশুর, জয়পুর এবং হায়দ্রবাদের দেওয়ান স্যার মির্জা ইসমাইলের কনিষ্ঠ। গওহর তাজ ছিলেন একজন সমাজসেবী এবং সমাজসেবী সুন্দর সিঙ্গাপুরের অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিলেন। শাকারাহের বড় ভাই মির্জা করিম নামাজী ছিলেন একজন সাংবাদিক।
শাকেরাহ ১৯৬৫ সালে নিজেদের আত্মীয় অত্যন্ত মেধাবী আকবর মির্জা খালিলির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আকবর আলি মির্জা ইরান ও অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। আকবর ও শাকেরাহ চারটি কন্যা সন্তান হয়। তাদের এই সুখী দাম্পত্য জীবনের মাঝে আবির্ভূত হয় এক ভদ্রবেশী শয়তানের মুরলি মনোহর মিশ্র নামক একজন ব্যক্তির সঙ্গে। মুরলি মনোহর ছিলেন দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা একজন, যে কিনা স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি, ছিলেন একজন ভণ্ড সাধু এবং আপাতদৃষ্টিতে একজন কাজের লোক। সরলমনা, সুন্দরী, ধনাঢ্য, উদারচেতা, সমাজসেবী শাকেরাহ পরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়নের চেষ্টায় থাকে।
সুযোগ সন্ধানী মুরলি কিছু সম্পত্তির সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে এবং অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে শাকেরাহর ছেলে সন্তান লাভের ইচ্ছা পূরণের কথা বলে তার প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন। শাকেরাহ অগাধ সম্মতির উত্তরাধিকার হিসাবে একটা ছেলে সন্তানের খুব ইচ্ছা ছিল। আর এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে মুরলি মনোহর মিশ্র। ধরলেন সন্ন্যাসী বেশ নাম নিল শ্রদ্ধানন্দ। গভীরভাবে জায়গা করে নিল কোটি কোটি টাকার মালকিন সুন্দরী শাকেরাহের হৃদয়ে।
চাকরিসূত্রে ইরান চলে যান আকবর। স্বামী বিদেশে গেলেও শাকিরা রয়ে গিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতেই। সেই সময়ে শাকিরা এবং শ্রদ্ধানন্দের ঘনিষ্ঠতা চরমে পৌঁছোয়। শ্রদ্ধানন্দের প্রেমেও পড়েন শাকিরা।
সালটা ১৯৮৬, শাকেরাহ ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিল। দ্বিতীয় বার বিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন ভিন্নধর্মী শ্রদ্ধানন্দের সঙ্গে। এই ঘটনা তৎকালীন সময়ে 'টক অব দ্যা টাউন' -এ পরিণত হয়।
শ্রদ্ধানন্দকে বিয়ের বিষয়টি শাকিরার মেয়েরা মেনে নিতে পারেননি। তিন মেয়ে শাকিরার সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বাবার কাছে চলে যায়। একমাত্র সাবা শাকিরার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পরে তিনিও মডেলিংয়ের জন্য মুম্বইয়ে চলে যান।
অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে শুরু হওয়া সংসার কিছু দিন যেতে না যেতেই আসল ঘটনা বুঝতে পারে শাকেরাহ। বুঝতে পারে শ্রদ্ধানন্দ আসল লক্ষ্য। ততদিনে সব কূল হারিয়েছেন রয়্যাল স্টেটের মালকিন শাকেরাহ। বন্দি হয়ে পড়ে দ্বিতীয় স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হাতে। শাকেরাহকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে জমির ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ পাওয়ার জন্য। সেটাও একসময় পেয়ে যায়।
এরপর চলতে থাকে ভয়ঙ্কর সেই নারকীয় পরিকল্পনা। এর মধ্যেই রিচমন্ড রোডের সেই বাড়িতে যান শ্রদ্ধানন্দ। ওই বাড়ির পরিচারকদের একটি বড় কাঠের বাক্স বানানোর নির্দেশ দেন তিনি। পরিচারকদের বলেছিলেন, সোনা-রুপোর গয়না রাখতে ওই বাক্স প্রয়োজন। সেজন্যে তিনি এটা করছেন। একই সঙ্গে কয়েক জন পরিচারককে বাড়ির পিছনে বড় গর্ত খোঁড়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন শ্রদ্ধানন্দ। তাঁদের জানানো হয়, জলের একটা বড় ট্যাঙ্ক বানানো হবে ওই জায়গায়। সেইমতো পরিচারকেরা বড় একটি গর্তও খুঁড়েছিলেন।
এরপর সেই ভয়ঙ্কর কালরাত্রি উপস্থিত হল।
পথের কাঁটা শাকেরাকে সরিয়ে ফেলতে মরিয়া শ্রদ্ধানন্দ। চরম সিদ্ধান্ত নেন ১৯৯১সালের ২৮ এপ্রিল। পরিকল্পনামতো শাকিরার চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধানন্দ। শাকিরা অচৈতন্য হয়ে পড়লে তাঁকে রিচমন্ড রোডের ওই বাড়িতে নিয়ে যান তিনি। সেখানে জীবন্ত শাকেরাহকে ভরে ফেলা হয় কফিনে। এরপর পুঁতে ফেলা হয় গর্তে। কফিনে মধ্যে ভরে মাটিতে পুঁতে নৃশংস ভবে খুন করা হয় এক ধনাঢ্য সুন্দরী নারীর শাকেরাহকে। নজিরবিহীন নৃশংস খুনের এই ঘটনার সাক্ষী শুধুমাত্র অন্ধকার রাত নয় একজন ঘনিষ্ঠ পরিচারকও ছিল।
মেয়ে সাবা খলিলি বেশ কয়েকদিন মায়ের কোন খোঁজ না পেয়ে শ্রদ্ধানন্দের কাছে জানতে চাইলে, শ্রদ্ধানন্দ জানায় শাকেরাহ সন্তানসম্ভবা তাই বিদেশে গেছে। পারে শাকেরাহ শ্রদ্ধানন্দ মিথ্যা বলছে। সেজন্যে ১৯৯২ সালের ১০ জুন মায়ের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন সাবা। পুলিশকে তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৯১ সালের ১৯ এপ্রিল মায়ের সঙ্গে শেষ বার ফোনে কথা হয়েছিল। এর পরেই তদন্তে নামে পুলিশ। তিন বছর ধরে তদন্ত চালিয়ে শাকিরা খুনের মামলায় শ্রদ্ধানন্দকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এই খুনি শুধু মাত্র শাকেরাহকে নৃশংস ভাবে জীবন্ত পুঁতে মেরে ফেলে থেমে থাকেনি। শাকেরাহের জীবন্ত পুঁতে দেওয়া কবরের উপর নৃত্যের আসর বসাতো। আর হাড় হিম করা ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিচালক প্যাট্রিক গ্রাহাম ডকুসিরিজ Dancing on the Grave তৈরি করেন। ২০২৩ সালের ২১ এপ্রিল মুক্তি পায়। প্যাট্রিক গ্রাহাম দ্বারা পরিচালিত এই চার পর্বের ডকুমেন্টারি সারা বিশ্বে মুক্তি পায়। এটা ব্যতিক্রমী ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর বিশেষত্ব তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সাক্ষ্য ও শ্রদ্ধানন্দের সাক্ষাৎকারও তুলে ধরা হয়েছে।
তদন্ত নেমে পুলিশ জানতে পারে, শাকেরার যাবতীয় সম্পত্তির ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ পাওয়ার পর তাঁকে খুনের ছক কষে শ্রদ্ধানন্দ। ১৯৯৪ সালে শ্রদ্ধানন্দকে গ্রেফতার করে কর্নাটক পুলিশ। খুনে শ্রদ্ধানন্দকে সাহায্য করার জন্য গ্রেফতার করা হয়েছিল এক পরিচারককেও।
ওই পরিচারকের বয়ানের ভিত্তিতে শাকিরার দেহাবশেষ রিচমন্ড রোডের বাড়ির উঠোন খুঁড়ে বার করা হয়। ময়নাতদন্ত পাঠানো হয় সেই দেহাবশেষ। রিপোর্টে উঠে আসে, জ্যান্ত পুঁতে দেওয়ার কারণে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটে শাকেরাহর।
স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে ১৯৯৪ সালের ৩০ এপ্রিল শ্রদ্ধানন্দকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০০০ সালে কর্নাটকের নিম্ন আদালত শ্রদ্ধানন্দকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২০০৫ সালে কর্নাটক হাই কোর্ট সেই শাস্তি বহাল রাখে। এর পর সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে নৃশংস খুনি। আদলত ২০০৮ সালে মৃত্যুদণ্ডের বদলে শ্রদ্ধানন্দকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনায় শীর্ষ আদালত।
ক্রাইম ডকুমেন্টারির পরিচালক গ্রাহাম বলেন,
"বেশিরভাগ সত্যিকারের অপরাধভিত্তিক সিরিজে, একজন অপরাধীকে 'প্রতিভাবান' হিসাবে সামনে আনা হয়। কিন্তু আমি যে এমনটা চাইনি সে ব্যাপারে খুব পরিষ্কার ছিলাম। অবশ্যই শ্রদ্ধানন্দের কিছু গুন ছিল, তার মধ্যে একটি হল মানুষকে তার কথা বিশ্বাস করানোর ক্ষমতা।"
COMMENTS