বিশেষ প্রতিবেদন: এই দেশ ‘স্বীকারোক্তি আদায়ে ব্যবহার করা হয়েছিল নির্যাতন’: ১৯ বছর জেলে কাটিয়ে মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণ মাময় দোষী সাব্যস্ত...
বিশেষ প্রতিবেদন: এই দেশ
‘স্বীকারোক্তি আদায়ে ব্যবহার করা হয়েছিল নির্যাতন’: ১৯ বছর জেলে কাটিয়ে মুম্বই ট্রেন বিস্ফোরণ মাময় দোষী সাব্যস্ত ১২ জনই খালাস
এই খালাস প্রশ্ন তোলে রাজ্য তদন্তকারী সংস্থা—এই মালায় মহারাষ্ট্র অ্যান্টি-টেরোরিজম স্কোয়াড (ATS)—এর ভূমিকা নিয়ে, যারা এই মামলার তদন্ত করেছিল।
বম্বে হাইকোর্ট
সুকন্যা শান্থা,

মুম্বই, ২১ জুলাই:
একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে, বম্বে হাইকোর্ট আজ, ২১ জুলাই, সেই ১২ জন পুরুষকে খালাস দিয়েছে, যাদের ২০০৬ সালের ১১ জুলাই মুম্বই লোকাল ট্রেনে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনায় “যুক্ত থাকার”-এর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড ও সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ঘটনার ১৯ বছর পর এলো এই রায়, আর এই সময়টা তারা কারাগারে বন্দি ছিলেন।
মাত্র একজন, ওয়াহিদ শেখ, ২০১৫ সালে বিচারিক আদালত থেকে খালাস পান, কারণ তার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাকেও নয় বছর কারাগারে কাটাতে হয়েছিল।
ওয়াহিদ শেখ নিজের বাড়িতে
ওয়াহিদ দ্য ওয়্যার-কে বলেন, হাইকোর্ট বেঞ্চ—বিচারপতি অনিল কিলোর ও শ্যাম চাঁদক—পূর্ণভাবে প্রতিরক্ষা পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ করেছে যে তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। “আমরা বরাবরই বলেছি, শুধু আমি নয়, বাকি ১২ জনকেও মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। আজ আমরা প্রমাণিতভাবে নির্দোষ হলাম,” আবেগতাড়িত ওয়াহিদ ফোনে বলেন।
“এই মামলার সত্যিকারের নায়ক ছিলেন বিচারিক আদালতের আইনজীবীরা। তাঁদের জেরা অসাধারণ ছিল। হাইকোর্ট রায়ে সেই জেরাগুলোকেই গুরুত্ব দিয়েছে,” বলেন মামলার অন্যতম আইনজীবী প্রবীণ আইনজীবী নিত্যা রামকৃষ্ণন।
দুপুর নাগাদ প্রকাশিত রায়ের কপিতেও ওয়াহিদের কথার প্রতিফলন দেখা যায়। “স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিগুলো বিভিন্ন কারণে সত্য ও সম্পূর্ণ বলে মনে হয়নি, এমনকি কিছু অংশ হুবহু এক ও কপি করা ছিল,” ৬৬৭ পাতার রায়ে লেখা হয়েছে।
বিচারপতিরা বলেন, অভিযুক্তরা প্রমাণ করতে পেরেছেন যে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে এই স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছিল। স্বীকারোক্তিগুলো অবিশ্বস্ত বলে বিবেচিত হয়েছে বিভিন্ন কারণে—তার মধ্যে অন্যতম, কিছু বিবৃতির ‘পার্ট-১’ ও ‘পার্ট-২’ ছিল হুবহু এক। এটিই ছিল আত্মপক্ষ সমর্থনের ১০টি যুক্তির মধ্যে অন্যতম।
গত ছয় মাস ধরে হাইকোর্ট রাজ্য ও দণ্ডপ্রাপ্তদের করা আপিল শুনছিল। এই রায় রাজ্য তদন্ত সংস্থার ভূমিকা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
২০০৬ সালের ঘটনা ও মামলা
২০০৬ সালের ১১ জুলাই মুম্বই রেলপথের পশ্চিম লাইন ধরে সাতটি ট্রেনে বিস্ফোরণ হয়। ১৮৯ জন নিহত ও ৮২০ জন গুরুতর আহত হন। পুলিশের মতে, অভিযুক্তরা প্রেসার কুকারে বিস্ফোরক বস্তু রেখে সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়ে ট্রেনে রেখে গিয়েছিল।
তৎকালীন কংগ্রেস সরকার ATS-কে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। সেই সময় কংগ্রেসের শাসনে ATS পরিচালিত বেশ কিছু মামলাতেই মুসলিম যুবকদের সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়ে ভুলভাবে অভিযুক্ত করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে—যেমন মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা।
ফাঁসানো, নির্যাতন ও চাপ
খালাসপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজন—কামাল আনসারি, মোহাম্মদ ফয়সাল আতাউর রহমান শেখ, ইহতেশাম সিদ্দিকি, নাভিদ হোসেন খান ও আসিফ খান—দোষী সাব্যস্ত হন বোমা বসানো, সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ, এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এবং তাঁদের মৃত্যুদণ্ড হয়। আরো সাতজন—তানভীর আহমেদ, মোহাম্মদ মাজিদ, শেখ মোহাম্মদ আলি আলম, মোহাম্মদ সাজিদ, মুজাম্মিল শেখ, সুহেল শেখ এবং জামির আহমেদ—পান যাবজ্জীবন (মৃত্যু পর্যন্ত) কারাদণ্ড।
কামাল আনসারি ২০২১ সালে জেলেই মারা যান। ১৯ বছর ধরে তাঁদের কারো জামিন মঞ্জুর করা হয়নি—কোভিড মহামারী ও পারিবারিক মৃত্যুর মতো পরিস্থিতিতেও নয়।
মুক্তি শর্তহীন, PR বন্ডে ছাড়া
আজ হাইকোর্ট তাঁদের “পার্সোনাল রিকগনাইজেন্স (PR)” বন্ডে মুক্তি দিয়েছে—মানে কোনও আর্থিক শর্ত ছাড়াই। শেখ আলি আলম শেখের ছেলে বলেন, “আমার বাবা নাগপুর জেলে আছেন। রায়ের কপি পেলেই তাঁকে আনতে বেরোবো।”
‘ঘন ঘন হানা, দীর্ঘ নির্যাতন’
গত মাসে The Wire একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে জানানো হয়, অভিযুক্তরা জেলে থাকার পরেও তাঁদের পরিবারকে পুলিশ হেনস্থা করে, ঘন ঘন বাড়িতে হানা দিয়ে তথ্য জোগাড় করার নামে ভয় দেখানো হতো।
“এই রায়ের পর আশা করি আমাদের জীবন অবশেষে শুরু হবে,” বলেন শেখ আলির ছেলে সোহেল, যিনি গ্রেফতারের সময় শিশু ছিলেন।
ওয়াহিদ শেখ, যিনি গ্রেফতারের সময় শিক্ষক ছিলেন, ২০১৫ সালের মুক্তির পর “Innocence Network” নামে সংগঠন গড়েন। তিনি কারাজীবন নিয়ে বই লেখেন, ভারতীয় কারাব্যবস্থার উপর গবেষণা করে সম্প্রতি পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
আইনি লড়াই ও তদন্তের ফাঁকফোকর
এই মামলায় জড়িত আইনজীবীরা ছিলেন—নিত্যা রামকৃষ্ণন, ইউগ মোহিত চৌধুরী, এস নাগামুথু, এস মুরলীধর, ওয়াহাব শেখ, শরিফ শেখ, পায়োশি রায় ও স্তুতি রাই।
পুলিশ দাবি করে, অভিযুক্তরা লস্কর-ই-তইয়্যেবা-র সদস্য এবং পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। পুলিশ কমিশনার এ.এন. রায় দাবি করেন, কাশ্মীরি দুই যুবক মুম্বইয়ে এসে প্রচুর প্রেসার কুকার কিনেছিলেন, যা দিয়ে বোমা তৈরি হয়। অথচ এই প্রেসার কুকার থিওরি চার্জশিট থেকে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়—আট বছর পর আবার আদালতে তোলা হয়।
তদন্তে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন রামকৃষ্ণন ও রায়। তাঁরা বলেন, প্রেসার কুকার সংক্রান্ত তথ্য পুলিশ অনেক পরে তৈরি করে, অথচ আদালতে দেখানোর সময় দাবি করা হয় অভিযুক্তদের জবানবন্দিতে সেই তথ্য ছিল।
MCOCA আইন অপব্যবহার
এই মামলায় কঠোর MCOCA (Maharashtra Control of Organised Crime Act) আইন প্রয়োগ হয়, যেখানে পুলিশি হেফাজতে দেয়া স্বীকারোক্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য। অথচ, আইন অনুযায়ী এই অনুমোদন দেওয়ার জন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাক্ষ্য প্রয়োজন—যা এই মামলায় অনুপস্থিত ছিল।
‘এই তদন্ত ছিল মিডিয়া ট্রায়াল’
আইনজীবী মুরলীধর বলেন, এই তদন্ত একরকম মিডিয়া ট্রায়াল ছিল। “এভাবে নিরীহ মানুষদের জেলে ভরে রাখা হয়, আর বছর পর খালাস দিলে জীবন পুনর্গঠন করার আর সুযোগ থাকে না। প্রমাণের বদলে অভিযোগকে ধরে তদন্ত হয়।”
তিনি বলেন, “পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ পেশ করে, আর মিডিয়া সেটাকেই রায় ধরে ছাপে। এটা বহু সন্ত্রাসবাদ মামলায় দেখা গেছে।”
কে দোষী? উত্তর কোথায়?
এই খালাস শুধু ওই ১২ জনের নয়, বরং ১৮৯ জন নিহতের পরিবার আজও জানেন না কে তাঁদের প্রিয়জনদের হত্যা করেছিল। রাজ্য পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলোর জবাবদিহির সময় এসেছে।
COMMENTS