সম্পাদকীয়: Editorial নাগরিকত্ব, পরিচয় ও প্রতিহিংসার রাজনীতি: প্রশ্ন তুলছে জনগণ ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড কিংবা আধার কার্ড এসব নথি বা পরিচয়প...
সম্পাদকীয়:
Editorial
নাগরিকত্ব, পরিচয় ও প্রতিহিংসার রাজনীতি: প্রশ্ন তুলছে জনগণ
ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড কিংবা আধার কার্ড এসব নথি বা পরিচয়পত্রগুলোর যদি কোনো বৈধতা না থাকে, তবে কিসের ভিত্তিতে এতদিন ভোট গ্রহণ হয়েছে এবং কাদেরকে পাঠানো হয়েছে সংসদে?
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে একটি বক্তব্য এসেছে—ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড কিংবা আধার কার্ড এসব নথি নাকি ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। এই বক্তব্যে স্বাভাবিকভাবেই অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসছে—যদি এই পরিচয়পত্রগুলোর কোনো বৈধতা না থাকে, তবে কিসের ভিত্তিতে এতদিন ভোট গ্রহণ হয়েছে এবং কাদেরকে পাঠানো হয়েছে সংসদে?
ভারতের প্রতিটি নাগরিক পরিচয়পত্র হিসেবে যে নথিগুলি ব্যবহার করে থাকেন, তা দিয়ে সরকার কর আদায় করে, ভর্তুকি দেয়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং সবচেয়ে বড় কথা, ভোট গ্রহণ করে। সেই ভোটের ভিত্তিতেই গঠিত হয় সংসদ, বিধানসভা ও সরকারের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি পরিষদ। এখন যদি এই পরিচয়পত্রগুলিকে 'নাগরিকত্বের বৈধ প্রমাণ নয়' বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী, এমপি-মন্ত্রীদের নাগরিকত্বের প্রমাণ কী?
সরকার যেখানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে সীমান্ত সুরক্ষা জোরদার করছে, সেখানে প্রতিবেশী দেশ থেকে অবাধে প্রবেশ করে কেউ যদি পরিচয়পত্র তৈরি করে নেয়, তার দায় কি শুধু সাধারণ নাগরিকের? প্রশাসনের ভিতরে থাকা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী, দালালচক্র এবং রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা আজও জাল আধার, রেশন ও ভোটার কার্ড তৈরির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অনিয়ম রোধ না করে, বরং সাধারণ মানুষের ওপর ‘নাগরিকত্ব প্রমাণ করো’ চাপিয়ে দেওয়া আদতে প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভারতের সংবিধান সব নাগরিককে কাজ, বসবাস এবং মত প্রকাশের সমান অধিকার দিয়েছে। তাই এক রাজ্যের মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে গেলে যদি ভাষা বা জাতিগত পার্থক্যের কারণে ‘বিদেশি’ তকমা জুটে, তাহলে সেটা গণতন্ত্রের চরম অবমাননা। বর্তমান শাসক দল বারবার নাগরিকত্বের প্রশ্ন তুলে সংবিধানের মৌলিক অধিকারকে পদদলিত করছে। কখনও এনআরসি, কখনও এনপিআর, আবার কখনও ভাষাগত কিংবা ধর্মীয় পরিচয়ের নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করছে।
অবশ্যই, নাগরিকত্ব যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চালু করা হলে তা শুরু হোক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে। যে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড বা রেশন কার্ড দিয়ে তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে, তা যদি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় হয়, তাহলে তাদের নিজস্ব বৈধতার প্রশ্নও অস্বীকার করা যায় না।
ভারত বহু ভাষার, বহু ধর্মের এবং বহু সংস্কৃতির দেশ। একে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব জনগণেরই। কিন্তু আজ সেই জনগণকে ঘন ঘন লাইনে দাঁড় করিয়ে, পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য করে, প্রশাসনিক জুলুম ও অবমাননার মধ্যে ফেলা হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে এবং সমাজে ভয় ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বস্তুত, নাগরিকত্ব প্রমাণ নয়—প্রমাণ হোক দুর্নীতি মুক্ত প্রশাসন, স্বচ্ছ ভোটব্যবস্থা এবং সবার জন্য সমানাধিকার। দেশকে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গেলে প্রতিদিন কাগজপত্র দেখাতে হয় না—বরং সৎ জীবনযাপন, পরিশ্রম এবং মানবিক মূল্যবোধই আসল প্রমাণ।
তাই সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার—যারা নাগরিকদের ‘বেনাগরিক’ বানাতে চাইছে, তাদের প্রতিহত করা এটা একটা গণতান্ত্রিক দায়িত্ব। আর সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে পথে নেমে, কণ্ঠ তুলে—যাতে আমাদের দেশ সবার হয়, কেবল কারও নয়।
COMMENTS