বিশেষ প্রতিবেদন: আন্তর্জাতিক নিউ ইয়র্কে মেয়র পদপ্রার্থী ৩৩ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানী কে? সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র ...
বিশেষ প্রতিবেদন: আন্তর্জাতিক
নিউ ইয়র্কে মেয়র পদপ্রার্থী
৩৩ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত জোহরান মামদানী কে?
সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র পদের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুবক জোহরান মামদানী। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নির্ধারণ হয় প্রাইমারি নির্বাচনের মাধ্যমে, যেখানে দলীয় নেতাদের মনোনয়ন নয়, বরং প্রার্থীদের মধ্যে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচিত হয়। অর্থাৎ, মামদানী এখন ডেমোক্রেটিক পার্টির আনুষ্ঠানিক মেয়র পদপ্রার্থী এবং আগামী ৫ নভেম্বর মূল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
নিউ ইয়র্ক শহরের নির্বাচন কেবল আমেরিকাতেই নয়, এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে ইসরায়েল পর্যন্ত। এমনকি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ফলাফল ঘোষণার পর মামদানীকে ব্যঙ্গ করে “কমিউনিস্ট” বলে মন্তব্য করেছেন। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে মামদানীর রাজনৈতিক আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ভারতীয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীরাও তার প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছে, বিশেষত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তার কঠোর সমালোচনার কারণে।
পারিবারিক জীবন:
জোহরান মামদানীর পিতা ড. মাহমুদ মামদানী জন্মগ্রহণ করেন ভারতের মহারাষ্ট্রে। শৈশবে চলে যান উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় তানজানিয়ার দার এস সালাম শহরে এবং পরবর্তীতে পেনসিলভানিয়ার ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বর্ণ বৈষম্য ও মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং এজন্য কারাবরণও করেন।
১৯৯১ সালে মাহমুদ মামদানী বিয়ে করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ারকে, যিনি একজন পাঞ্জাবি হিন্দু এবং ভারতের ওড়িশা রাজ্যের বাসিন্দা। জোহরান মামদানী জন্মগ্রহণ করেন কাম্পালায়। তার পিতা একজন শিয়া মুসলিম এবং মা একজন হিন্দু, তবে জোহরান নিজেকে শুধুমাত্র 'মুসলিম' হিসেবে পরিচয় দেন — কোনও গোত্রীয় বিভাজনে বিশ্বাস করেন না।
শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড:
শিশু অবস্থায় তার পরিবার প্রথমে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন, পরে নিউ ইয়র্ক শহরে চলে আসে, যেখানে তিনি স্কুল জীবন শেষ করেন এবং এরপর Bowdoin College (মেইন রাজ্যে অবস্থিত) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন একজন মানবাধিকার কর্মী এবং কলেজে "Students for Justice in Palestine" নামক সংগঠনের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ প্রতিরোধে সহায়তা, আইনি সাহায্য প্রদান, এবং নিম্নআয়ের মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। মায়ের প্রভাবে তিনি সংগীতপ্রেমী হয়ে ওঠেন এবং মীরা নায়ারের কয়েকটি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনাও করেন।
রাজনৈতিক জীবন ও মেয়র পদপ্রার্থী:
জোহরান রাজনীতিতে সক্রিয় হন বিভিন্ন প্রগতিশীল প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তিনি যুক্ত হন Democratic Socialists of America-এর সঙ্গে। ২০২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০২২ ও ২০২৪ সালে পুনর্নির্বাচিত হন। তিনি এখন পর্যন্ত ২০টি বিল উত্থাপন করেছেন এবং ২৩০টিরও বেশি বিল নিয়ে কাজ করেছেন।
২০২৪ সালের অক্টোবরে তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়র পদে প্রার্থীতা ঘোষণা করেন। এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ, কারণ নিউ ইয়র্কে ইসরায়েলের পর বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইহুদি জনগোষ্ঠী বসবাস করে এবং এ ধরনের জায়গায় ফিলিস্তিনের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া রাজনীতিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তবুও মামদানী একাধিকবার বলেন, 'ধর্ম নয়, মানুষের অধিকারই প্রধান'। তিনি গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং বলেছেন, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যদি নিউ ইয়র্ক আসেন, তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (ICC) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুযায়ী আটক করা উচিত।
তার মা মীরা নায়ারও তার মতোই ফিলিস্তিনের পক্ষে। ২০১৩ সালে তাকে ইসরায়েলের হাইফা ফিল্ম ফেস্টিভালে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং লিখেন:
'আমি তখনই ইসরায়েল যাব, যখন
🔹 ইহুদি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দেয়াল ভেঙে ফেলা হবে
🔹 দখলদারিত্ব শেষ হবে
🔹 কোনও ধর্ম অন্য ধর্মের উপরে থাকবে না
🔹 বর্ণবাদ শেষ হবে”
ভোটাভুটির ফলাফল ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জঝ:
প্রথমে ১০০ জনেরও বেশি প্রার্থী ছিলেন, কিন্তু শেষে টিকে থাকেন মাত্র ১২ জন। মূল লড়াই হয় প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো ও জোহরান মামদানীর মধ্যে। কুয়োমো বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়িত ছিলেন — দুর্নীতি, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজি — যার ফলে তিনি গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
অন্যদিকে মামদানীর পক্ষে ছিলেন বার্নি স্যান্ডার্সসহ একাধিক প্রগতিশীল নেতা এবং দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটির বিশেষ করে পাকিস্তানি, ভারতীয় ও বাংলাদেশি নারীদের নেতৃত্বে এক জোরদার ঘরে ঘরে প্রচারণা। ফলাফলে দেখা যায়:
🟩 জোহরান মামদানী: ৪৩.৫১%
🟥 অ্যান্ড্রু কুয়োমো: ৩৬.৪২%
এখনো কুয়োমো প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস ও রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
আগামী ৫ নভেম্বর মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এই নির্বাচনে জোহরান মামদানীকে হারানোর জন্য আমেরিকার চরমপন্থী গোষ্ঠী, ইসরায়েলি লবি, এমনকি ট্রাম্প পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। কিন্তু তার আদর্শিক দৃঢ়তা, সমাজসেবামূলক অভিজ্ঞতা, ও প্রগতিশীল রাজনীতি তাকে একটি নতুন প্রজন্মের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছে।
COMMENTS